মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ২-৩রা পৌষ ১৪১৬/১৬-১৭ই ডিসেম্বর ২০০৯ বুধ ও বৃহস্পতিবার দুই দিনব্যাপী বাংলা একাডেমী আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আজ শেষ দিন। বিকেল ৪:০০টায় একাডেমীর নজরুল মঞ্চে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। স্বাগত ভাষণ প্রদান করেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আলোচনা করেন বিশিষ্ট সমাজকর্মী, এডভোকেট সুলতানা কামাল এবং বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন তারেক আলী। সভায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।
স্বাগত ভাষণে শামসুজ্জামান খান বলেন, বাঙালির হাজার বছরের সাধনার, স্বপ্নের, সংগ্রামের ঐতিহ্যের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রসত্তা নির্মাণ করেছে যেখানে মানুষ এবং মানবিক মূল্যবোধই প্রধান। ইতিহাসের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে ওঠার যে মানবিক পদ্ধতি তার বৈশিষ্ট্যসমূহকে নিয়েই আমাদের এই বাংলদেশ। আমাদের মনে রাখতে হবে এই রাষ্ট্রের ভিত্তমূলে বাঙালির সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, সংস্কৃতির বোধ, মনুষ্যত্বের বোধ সবসময় সোচ্চার ছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সহযোদ্ধারা এই বিষয়টিকে চিন্তা-চেতনায় রেখেই এমন একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, গোটা এশিয়া মহাদেশেই অনন্য। এই রাষ্ট্রের সত্তা, বৈশিষ্ট্য, ধর্মনিরপেক্ষতার যে চারিত্র্য সেটি প্রতিমুহূর্তে যদি আমরা মনে রাখতে না পারি তাহলে স্বাধীনতা-মুক্তি-একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যে যে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি জীবন দান করেছেন তাঁদের আত্মার প্রতি অবমাননা করা হবে। তিনি বলেন, আধিপত্যবাদী, কর্তৃত্বপ্রবণ এবং চক্রান্তকারী নানা ক্ষুদ্রগোষ্ঠী বাংলাদেশকে নিয়ে অশুভ তৎপরতা চালিয়েছে  এর ফলে রাষ্ট্রের মধ্যে যে কুউপাদানগুলো ঢুকে গেছে তাকে দূর করার লক্ষ্যে ’৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন করে আমাদেরকে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউদ্দিন তারেক আলী বলেন, যে দু’টি মূল কারণে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়েছিল তারমধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চেয়েও বড় ছিল বাঙালি সংস্কৃতির উপর উত্তর ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতির আগ্রাসন। আমাদের দেশজ সংগীতের ধ্বনি প্রতিটি বাঙালির মনে সবসময় দোলা দেয় এবং উদ্বেলিত করে। তাই দেশের মানুষ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখতে মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে, ছিনিয়ে আনে মহান বিজয়।
এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সহযোদ্ধাদের জীবন দানের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি বলেই আজ আমরা মাথা উঁচু করে কথা বলছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মহান এ আত্মত্যাগের ফলেই আমরা বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা পেয়েছি। তিনি বলেন, আজকের বাংলাদেশকে আগামীর দিকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নতুন প্রজন্মের। এজন্য নতুন প্রজন্মকে এখনই এগিয়ে আসতে হবে, তাদেরকে বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে।
প্রধান অতিথির ভাষণে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, স্বাধীনতার পর ’৭২-এর সংবিধান প্রণীত হয়েছিল কোনোরকম সমালোচনা ছাড়াই। এই সংবিধানে দেশের সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ ’৭২-এর সংবিধানকে বিকৃত করে ফেলে, যা দেশ ও জাতির জন্য খুবই অপমানের। এখন সময় এসেছে ’৭২-এর সংবিধানকে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার।
সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেন, ’৭১-এ পরাক্রমশালী অপশক্তির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে। এটা একটি জাতির জন্য অনেক গর্বের। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। তা না-হলে বারবারই আমরা ভুল করবো, অর্জিত বিজয়ের লক্ষ্য থেকে আমরা বিচ্যুত হব এবং পিছিয়ে পড়বো। তরুণ প্রজন্মকে অবশ্যই শতবাধা অতিক্রম করে প্রকৃত ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়ে, মানবতার ধর্মে দীক্ষিত হয়ে দেশের কাজ করায় মনোযোগী হতে হবে। কারণ তরুণ প্রজন্মই পারে জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে।
আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে সুভাষ সিংহ রায়ের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ‘বঙ্গবন্ধুর গল্প শোন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে গল্প করেন সাংবাদিক বেবী মওদুদ, বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী আলী যাকের, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম এবং স্বাধীনতা ফার্মাসিস্ট পরিষদের আহ্বায়ক সেলিম আজাদ চৌধুরী। তাঁরা বলেন, জাতির পিতা হওয়ার জন্য যে পরিমাণ আত্মত্যাগ ও মহিমা প্রয়োজন ছিল তার পুরোটাই ধারণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, নিজেকে গড়ে তুলেছেন ধাপে ধাপে এবং পরিণত হয়েছেন মহান নেতায়। তাঁর এই রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফলে পুরো জাতিকে উজ্জীবিত করে মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘দেশ, ভাষা ও ভালোবাসা’র গান পরিবেশন করেন শিশু-কিশোর শিল্পীবৃন্দ।