বাংলা একাডেমী ২৭শে আগস্ট ২০০৯ বৃহস্পতিবার বেলা ১১:০০টায় একাডেমীর সেমিনার কে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলে আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে ‘উপনিবেশবাদ-বিরোধী কবিতা ও নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন কবি, গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলিম এবং বিশিষ্ট গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আইনুন নাহার। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক এবং সম্মানিত ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস-এর উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিাবিদ, গবেষক, জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা একাডেমীর সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। সকালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধে পুস্পাঞ্জলি অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। এ সময় একাডেমীর সচিব, পরিচালকবৃন্দ এবং অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
স্বাগত ভাষণে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, সামগ্রিকভাবে কবি নজরুল এই উপমহাদেশের এক অসাধারণ পুরুষ ছিলেন। এমন এক বিরল প্রতিভা, বিচিত্র উৎস থেকে শিল্পনির্মাণের কৌশল আয়ত্ত¡কারী একজন সৃষ্টিনিপুণ পুরুষপুরো বাংলাদেশে ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিহীনতার মধ্যে, বুদ্ধির বিভ্রান্তির মধ্যে কি করে জন্ম নিয়েছিলেন সেটি ভেবে বিস্মিত হতে হয়। তিনি বলেন, নজরুলকে ১৯২৯ সনে কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালির জাতীয় কবি হিসেবে, জাতীয় বীর হিসেবে যে সংবধর্না দেয়া হয়েছিল তারই অনুসরণে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে অভিষিক্ত করা হয়। তিনি আরও বলেন, নজরুলকে নিয়ে এ পর্যন্ত যতো আলোচনা হয়েছে তাতে ভৌগোলিক বিস্তার ঘটেছে, কিন্তু ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণা ও বিশ্লেষণে যে গভীরতা প্রয়োজন, তা আজও হয়নি।
প্রাবন্ধিক অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেন বলেন, উপনিবেশবিরোধী সংগ্রামের নিশানবরদার নজরুল জানতেন উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামে প্রথম দরকার সা¤প্রদায়িক ঐক্য।  তাঁর দৃষ্টি ছিল উপনিবেশ-শৃঙ্খলমুক্তি পেরিয়ে সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তায় সমর্পিত। তিনি বলেন, আজকের দিনে সর্বাধিক প্রয়োজন নির্মোহ সাহিত্যালোচনা, সেইটিরই অসম্ভব অভাব। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে একটি প্রবল পরাক্রান্ত নাম। তাঁকে নানাভাবে, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করা দরকার।
অধ্যাপক আইনুন নাহার বলেন, কবি নজরুল ইসলাম ছিলেন দার্শনিক, সাম্যবাদী ও মানবিক কবি। বর্তমান সময়ে আমরা নারীর অধিকার নিয়ে যে কথা বলি নজরুল বহু আগেই তাঁর লেখনির মাধ্যমে ধারণ করেছেন। তিনি কথা বলেছেন শ্রেণীবৈষম্য ও সা¤প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি ছিলেন জাতীয়তাবাদী কবি। নজরুলের লেখনি ছিল নিæবর্গের দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। নজরুল চেয়েছিলেন উপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি। নজরুলকে যদি আরও ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয় তবেই আমরা জাতীয় জীবনের মুক্তি খুঁজে পাব।
অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলিম বলেন, অসম্ভব প্রতিভা এবং সংবেদনশীল মন নিয়ে নজরুলের জন্ম হয়েছিল। নজরুলের কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধর্মের সাম্যবাদী ধারা। নজরুল শ্রমিকের রক্তকে বুলেট বানিয়ে তা সাহিত্যে ধারণ করেছেন। তিনি ছিলেন বাঙালি সত্তার প্রতিক।
প্রধান অতিথির ভাষণে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, নজরুল শুধু আমাদের উপনিবেশবাদ নিয়েই অনুপ্রেরণা যোগাননি, তিনি সমগ্র বিশ্বের উপনিবেশিবাদের বিরুদ্ধে কবিতা লিখেছেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ শক্তির জন্য ভীতিস্বরূপ। বাংলার প্রথম শ্রেণীসচেতন লেখক কবি নজরুল সা¤প্রদায়িকতা নিয়ে তিনি আন্দোলন করেছেন। তিনি বলেন, পাশ্চাত্যের তত্ত¡ থেকে বেরিয়ে এসে নজরুলকে আমাদের নতুনভাবে ভাবতে হবে।
সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউম বলেন, নজরুল ছিলেন একান্তভাবে সংগ্রামী পুরুষ। উপনিবেশশক্তির বিরুদ্ধে যাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নজরুল তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছেন তাঁর লেখনির মাধ্যমে। তিনি ঔপনিবেশিকদের শুধু সমালোচনাই করেননি, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতেও বলেছেন। সামগ্রিকভাবে তিনি ছিলেন একজন বিদ্রোহী কবি। নজরুলের ল্য ছিল সাম্রাজ্যবাদ শক্তিকে নস্যাৎ করে স্বাধীনতা অর্জন করা। তিনি বলেন, নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুল সাহিত্যের মূল্যায়ন করলেই আমরা সৃষ্টিশীল নজরুলকে খুঁজে পাব।
অনুষ্ঠানে নজরুলের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ ও ‘অভিভাষণ’-এর অংশবিশেষ আবৃত্তি করেন জনাব এস. এম. মাহিদুল ইসলাম।